1,015 total views
তোর সব বন্ধু বান্ধবদের নাম, নাম্বার আর ঠিকানা এখানে লিখে দে।
মনোয়ারা বেগম একটা কাগজ নিতুর দিকে এগিয়ে দিয়ে কথা টা বললেন। নিতু বিরক্তি চোখে মায়ের দিকে তাকালো।
-ওদের নাম, নাম্বার দিয়ে তুমি কি করবে?
-দরকার আছে।
-কিসের দরকার?
-এত কৈফিয়ত তোকে দিতে পারবো না।
-মা, তোমার কি মনে হয় না তুমি বাড়াবাড়ি করছো?
চেঁচিয়ে কথাটা বলল নিতু। নিতুর চিৎকার শুনে সারোয়ার হোসেন পাশের রুম থেকে চলে আসলেন।
-কি হয়েছে মামনি?
বাবাকে দেখে সে অভিযোগের সুরে বলল,
-আমার সব বন্ধুদের নাম, ঠিকানা, নাম্বার সবকিছু এখানে লিখে দিতে বলছে। আমি কি চোর না ডাকাত? আমার উপর এভাবে নজর কেন রাখতে হবে?
বাবা একটু হেসে নিতুর পাশে বসলেন। মা তখনও দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। তারও কিছুটা রাগ হচ্ছে। বাবা আদুরে স্বরে বললেন,
-ঠিকই তো। আমার মেয়েটা কি চোর না ডাকাত? ওকে এরকম নজরে নজরে রাখবে না তো মনোয়ারা।
-তোমরা যা মন চায় করো।
এই বলে তিনি রেগে চলে গেলেন। বাবা নিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-আমার তো প্রমোশন হলো। তোরা ভালো কিছু হলে বন্ধুদের থেকে কি যেন নিস?
-ট্রিট?
-হ্যা। আমার থেকে ট্রিট নিবি না?
নিতু খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল,
-তুমি আমাকে ট্রিট দিবে??
-শুধু তোকে কেন? তোর সব ফ্রেন্ডসকেও দিবো। তুই পরশুদিনই সবাইকে আমাদের বাসায় আসতে বল।
-আচ্ছা। আমি সবাইকে বলে দিচ্ছি।
-মেয়ের সাথে কি প্লানিং হলো শুনি?
বাইরে বেড়িয়ে আসতেই মনোয়ারা জিজ্ঞেস করলেন কথাটা।
-তুমি ওর সব বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলে তো? পরশু দিন ওরা সবাই বাসায় আসবে। সামনাসামনি নাহয় আলাপ করে নিও।
-ও তোমার সাথে সবকথা শেয়ার করে। আমার সাথে কেন করে না?
-বলবে, বলবে। ওত ভেবো না।
কলেজ থেকে ফিরে নিতুকে ভীষণ রাগান্বিত মনে হলো। ব্যাগ টা কাধ থেকে রেখে সে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
-তুমি যে আমাকে সন্দেহ করো সেটা কি সবাইকে জানান দিতে হবে?
-কি করেছি আমি?
-তুমি রাইসাকে ফোন দিয়ে ঘুরিয়ে জানতে চেয়েছো আজকে আমাদের ক্লাস ছিল কিনা? ওরা হাসিঠাট্টা করছিলো এটা নিয়ে।
-আসলে তোর ফোন বন্ধ পেয়েছিলাম। তাই ওকে ফোন দিয়েছি।
-আমার ফোন অন ই ছিল। তুমি ইচ্ছে করে ওকে কল দিয়েছো। ভেবেছো আমি মিথ্যা বলে ক্লাস করতে গিয়েছি। এখন থেকে আর কলেজেই যাবো না।
এই বলে নিজের রুমে চলে গেল সে।
ধীরে ধীরে মায়ের সাথে দূরত্ব বাড়ছে নিতুর। আগে তার মায়ের সাথে সে অনেক গল্প করতো, নিজের কথা শেয়ার করতো। কিন্তু এখন সেরকম করে না।
-নিতু, কি করছিস মা?
বাবা এসে জিজ্ঞেস করলেন।
-কিছু না, বাবা। তোমাকে যে বলেছিলাম আমার একটা নতুন ব্যাগ লাগবে। সেটা এনে দিলে না তো।
-ও হ্যা ভুলে গেছিলাম। তোকে দশদিন পরে এনে দিবো। দশদিন পর পেলে কোনো সমস্যা হবে?
-কোনো সমস্যা হবে না।
-কিন্তু তার জন্য তোকে একটা টাস্ক পূরণ করতে হবে।
-কি টাস্ক?
-তোর মা তো বিকাল ৪ টায় বাসায় ফেরে। তোকে প্রতিদিন ৪ টা বাজার কিছুক্ষণ আগে তোর মাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইতে হবে সে কখন বাসায় ফিরছে।
নিতু ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তুমি কি আমাকে ডেয়ার দিচ্ছো?
-তুই ডেয়ার ভাবলে ডেয়ার ই এটা।
-আচ্ছা। আমি ঠিক দশদিন মাকে কল দিবো।
-আচ্ছা। ডান তাহলে।
সিএনজিতে করে বাসায় ফিরছিলেন মনোয়ারা। মেয়ের কল পেয়ে কিছুটা অবাকই হলেন তিনি। কলটা রিসিভ করতেই নিতু বলল,
-তুমি কখন ফিরছো, মা?
-এইতো আর একটু সময় লাগবে। তুই কি খেয়েছিস?
-আচ্ছা রাখছি।
আর কোনো বাড়তি কথা না বলে সে রেখে দিলো।
মনোয়ারা বেগম কিছুক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পরের দিনও একই ভাবে নিতু কল করলো। আর কখন বাসায় ফিরবে সেটা জিজ্ঞেস করলো। এবারে মা যখন খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলো সেটার উত্তর দিলো
ধীরে ধীরে মায়ের সাথে কথা বলার পরিমান বাড়ছে তার। তার স্কুলে কি হয়েছে না হয়েছে শেয়ার করতে লাগলো মায়ের সাথে। মাও তার ছোটবেলার কথা শেয়ার করতে লাগলেন।
সরাসরি এসব কথা মায়ের সাথে না বললেও এখন সেসব ফোন কলে হতে থাকে। নিতু নির্দিধায় সব কথা ফোনে বলতে থাকে। মা আর নিতুর দুজনেই বাসায় ফেরার সময় ফোনকলে এই গল্পগুলো উপভোগ করেন এখন।
কথা বলতে বলতে সিএনজি কখন যে বাসার সামনে এসে গেছে মনোয়ারা বুঝতে পারেন নি।
সিএনজি থেমে আছে। ড্রাইভার পিছনে ফিরে বলল,
-ম্যাডাম..
মনোয়ারা ইশারা করলেন চুপ করার জন্য। তিনি নিঃশব্দে সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলেন।
বাড়ির সামনের সিমেন্টের বেঞ্চটায় বসে গেলেন তিনি। তার মনে হচ্ছে তিনি বাসায় গেলেই তার মেয়ে তার সাথে এমন মন খুলে কথা বলবে না। কথার মাঝখানে নিতু জিজ্ঞেস করলো,
-মা, তুমি কখন আসবে?
মনোয়ারা উত্তর দিলেন,
-আর দশ মিনিট লাগবে। ততক্ষণ কথা বলি?
কথা বলতে বলতে নিতু বারান্দায় চলে এসেছে। বারান্দা থেকে সে স্পষ্ট দেখলো মা বাসায় ফিরে এসেছে। আর বাড়ির নিচে বসে আছে। নিতু হাসতে হাসতে বলল,
-বাড়ির নিচে থেকে তিন তলায় আসতে তোমার ১০ মিনিট লাগবে, মা?
লজ্জা পেয়ে মা কল কেটে দিলেন।
নতুন ব্যাগ টা নিতুর হাতে তুলে দিয়ে বাবা বললেন,
-তুই তোর টাস্ক বা ডেয়ার যেটাই বলিস সেটা পূরণ করেছিস। কালকে থেকে আর মাকে ফোন দেয়া লাগবে না।
নিতু মুখটা কালো করে ব্যাগটা নিলো।
পরের দিন থেকে আর কল আসার কথা না। অথচ মনোয়ারা বেগমের ফোনে সেদিন বিকেল বেলাও কল আসলো। নিতু কল করেছে। কল রিসিভ করতেই নিতু জিজ্ঞেস করলো,
-মা, তুমি কখন ফিরছো?
(সমাপ্তি)
মা, তুমি কখন ফিরছো?
লেখকঃ অরণী মেঘ